জিয়াউর রহমান জিতু (মীরসরাই):-
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মো. সেলিম নামের এক ভারতীয় নাগরিকের বাংলাদেশী জাল জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরী করে এবং তার ছেলেকে জিম্মি করে তার কাছ থেকে অন্যের ভোগদখলীয় ১০.৬০ শতক জমি রেজিষ্ট্রি করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত ৭ এপ্রিল মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে এই জমি রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন করে একটি জালিয়াত চক্র (রেজিষ্ট্রি নং- ৯৮৪)।
জালকৃত ওই বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্রের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে এই বিষয়ে জানতে চেয়ে আবেদন করা হলে, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ এর বৈধ ও সঠিকতা যাচাইকরণ ইউনিট এর সহকারী পরিচালক মুহা: সরওয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত এক লিখিত প্রতিবেদনে জানানো হয় “উল্লিখিত ব্যক্তি মোহাম্মদ সেলিম, পিতা- নুরুল ইসলাম, জাতীয় পরিচিতি নম্বর- ১৯৫৮১৫১৫৩৭৭৪৬১৪৭০ অনুসন্ধান করে জাতীয় তথ্য ভান্ডারে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।” (স্মারক নং- ১৭.০০.০০০০.০৬৪.৫১.০৩০.১৮-১৫৫, তাং ২৯ মে, ২০১৯ইং)
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ চক্রের মূল হোতা কামরুল আনোয়ার মিলন পেশায় একজন দলিল লিখক। তিনি উপজেলার কাটাছড়া ইউনিয়নের ইদিলপুর গ্রামের মৃত নুরুল হাদির সন্তান। কামরুল আনোয়ার মিলনের বিরুদ্ধে তার নিজ গ্রামের আরো ব্যক্তির সাথে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। মিলনের দ্বারা প্রতারিত তার আপন জ্যাঠাতো বোন নুরজাহান বেগমকে প্রতিবেদককে জানান, ২০০৮ সালে মাত্র ২৯ হাজার টাকার বিনিময়ে এক শতক জমি ক্রয়ের কথা বলে প্রতারনা করে তার পৈতৃক সকল সম্পত্তি রেজিষ্ট্রি করে নেয় কামরুল আনোয়ার মিলন।
ভূক্তভোগী ভারতীয় নাগরিক মো. সেলিম জানান, গত ৩১ মার্চ তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং গত ০৬ এপ্রিল তার ছোট ছেলে মো. ইমরান শেখকে সাথে নিয়ে মিরসরাইয়ে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে আসেন। এই খবর পেয়ে তার চাচাতো ভাই দলিল লেখক কামরুল আনোয়ার মিলন এবং মিলনের বড় ভাই মোস্তফা আনোয়ার স্বপন গত ৭ এপ্রিল মো. সেলিম ও তার ছেলেকে স্বপনের জোরারগঞ্জের একটি ভাড়া বাসায় মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রন জানান। সে অনুযায়ী মো. সেলিম তার ছেলেকে নিয়ে ৭ এপ্রিল স্বপনের বাসায় যাওয়ার পর মিলন ও স্বপন গং তার ছেলে মো. শেখ ইমরানকে স্বপনের বাসায় আটকে রেখে তাকে জোর পূর্বক জোরারগঞ্জ সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে নিয়ে যান। এরপর মো. সেলিমকে ও তার ছেলেকে প্রান নাশের হুমকি দিয়ে জোর পূর্বক সাব-রেজিষ্ট্রারের সামনে জমির দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন।
মো. সেলিম আরো অভিযোগ করেন যে, তার নামে বাংলাদেশী ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করে (নং- ১৯৫৮১৫১৫৩৭৭৪৬১৪৭০) মিলন ও স্বপন গং তাদের পাঁচ ভাইয়ের নামে ১০.৬০ শতক জমিরু দলিল রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন করে। মো. সেলিম নিজেকে ভারতীয় নাগরিক (পাসর্পোট নং- টি ৪৬১৩৮৯৯) দাবি করে উল্লেখ করেন, তিনি স্বেচ্ছায় মিলন ও স্বপনদের জমি রেজিষ্ট্রি দেননি এবং তিনি বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য কোথাও কোন আবেদনও করেননি। তিনি এসময় আরো উল্লেখ করেন, রেজিষ্ট্রিকৃত ওই সম্পত্তি তিনি বিগত ০১.০৭.২০০৪ ইং তারিখে তার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র মো. মোসলেম উদ্দিন ও তার ছোট ভাইকে মৌখিক ভাবে দান করে দখল বুঝিয়ে দেন। এরপর ০৩.০৭.২০০৪ ইং তারিখে তিনি নোটারী পাবলিকের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ৫০ টাকার নন জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে (নোটারি রেজি: নং- ২৯৫৫) উক্ত মৌখিক দানের স্বীকৃতি পত্রও প্রদান করেন।
বাংলাদেশী বংশদ্ভুত ভারতীয় নাগরিক মো. সেলিমের নামে বাংলাদেশী জাল জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরির ঘটনা অনুসন্ধান করে দেখা যায়, রহস্যজনকভাবে মো. সেলিমের নামে তৈরী করা ওই জাল জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরের (নং- ১৯৫৮১৫১৫৩৭৭৪৬১৪৭০) সাথে মিরসরাই উপজেলার ওসমানপুর ইউনিয়নের মো. আরিফুল ইসলামের পরিচয়পত্রের নম্বরের (নং- ১৯৮৯১৫১৫৩৭৭৪৬১৪৭০) সাথে শুধু জন্ম সনের দুইটি অংকের অমিল রয়েছে বাকি সংখ্যাগুলোর সাথে হুবহু মিল রয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে, আরিফুল ইসলামের জাতীয় পরিচয়পত্রের আদলেই কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে মো. সেলিমের নামে জাল পরিচয় পত্র তৈরী করা হয়। জাল ওই জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহার করেই উপজেলার জোরারগঞ্জ সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসে গত ৭ এপ্রিল ১৯ ইং তারিখে ৯৮৪ নং রেজিষ্ট্রি সম্পাদন করা হয়। মো. সেলিম তার নামে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি এবং জোরপূর্বক জমি রেজিষ্ট্রি সম্পাদনের বিষয়টি গত ২৮ এপ্রিল, ১৯ইং তারিখে আদালতে হলফনামার মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন।
এই ব্যাপারে সাবএ রেজিষ্ট্রার দেলোয়ার হোসেন খন্দকার বলেন, কেউ যদি জাল জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে কোন দলিল রেজিষ্ট্রি সম্পাদন করে তাহলে তা বৈধ হবে না। এক্ষেত্রে ভূক্তভোগীরা আদালতের শরনাপন্ন হলে এই দলিল বাতিল হয়ে যাবে। তিনি আরো জানান, খুব সম্প্রতি দলিল লিখক কামরুল আনোয়ার মিলন দলিল লিখক সমিতির সভাপতিকে সাথে নিয়ে একটি দলিল রেজিষ্ট্রি করতে এসেছিলো, আমি তার দলিলে স্বাক্ষর করিনি। তার ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সর্তক ও সজাগ রয়েছি।
জাল জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে জমি রেজিষ্ট্রি করার বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন বলেন, যারা এধরনের কাজে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই ব্যাপারে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ জানালে আমরা সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিষ্ট্রারকে এই দলিল বাতিল করতে বলবো।
এই বিষয়ে অভিযুক্ত কামরুল আনোয়ার মিলন বলেন, জমির দাতা মো. সেলিম ও তার সন্তানকে জিম্মি করে রেজিষ্ট্রি নেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। তিনি স্বেচ্ছায় সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়ে দলিলে স্বাক্ষর করেছেন। আমরা প্রচলিত আইন মেনেই উক্ত দলিল রেজিষ্ট্রি সম্পাদন করেছি। ভূয়া জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোন জাল জাতীয় পরিচয়পত্র আমি তৈরি করিনি, দাতার জাতীয় পরিচয়পত্র তিনি নিজেই সরবরাহ করেছেন। আমি তো বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্রের নমুনাও কখনো দেখিনি।