শুভ সকাল ডেস্ক:-
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের মানবিক পুলিশ হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত কনস্টেবল/৬০৩৯ মমিন উল্যা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক (বন্দর) বিভাগে কর্মরত পিআইএমএস অপারেটর কনস্টেবল মমিন। গত ১৫ জুন অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার পথে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে টাইগার পাস মোড়ে চা খেতে এক দোকানে বসেন তিনি। চা এর অর্ডার দিলে দোকানদার চা দেন। কিন্তু পাশেই বসে থাকা এক অপরিচিত ব্যক্তি চায়ের কাপ নিয়ে দ্রুত খাওয়া শুরু করেন। প্রথমে থমকে গেলেও বুঝতে পারেন লোকটি চরম ক্ষুদার্ত এবং অসুস্থ। তাই তাঁকে আরও কিছু খেতে বললে সে একটি কলা খেতে চায়। পরে আরও একটি চা দেয়া হয় লোকটিকে। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন লোকটির নাম প্রতীক। বাবা মায়ের নাম জেনে তাদের মোবাইল নম্বর দিতে বললে একটি কাগজে নয়টি মোবাইল নম্বর দেয়। যার মধ্যে কয়েকটি ভুল নম্বর। এরপর প্রতীক ঘুমাতে চায়, অনেক অসুস্থ সে। প্রতীকের চুল দাঁড়ি পরিস্কার করতে দেওয়ান হাট মোড়ের দিকে যাওয়ার সময় কনস্টেবল মমিনের গায়ে বমি করে দেয় প্রতীক। জানায় সে চরম ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। তৎক্ষণাত ফার্মেসী থেকে কিছু ঔষধ ও খাবার স্যালাইন কিনে খাওয়ায় মমিন। এরপর সেলুনে গেলে কয়েকটি সেলুন তার চুল কাটতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ প্রতীকের শরীর থেকে চরম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। তারপর নতুন জামা কাপড় কিনে দিয়ে সেলুনে নিয়ে গিয়ে মমিন পুলিশের পরিচয় দিলে এক সেলুন তার চুল দাঁড়ি পরিস্কার করে দিতে রাজি হয়।
এরপর আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেও প্রতীকের চিকিৎসা করতে তারা অস্বীকৃতি জানায়। অসুস্থ প্রতীকের অবস্থা তখন আরও শোচনীয়। ব্লাড প্রেসার এবং হার্টবিট দুটোই পাওয়া যাচ্ছিল না। অনবরত পায়খানা করছিল প্রতীক। ডবলমুরিং থানার এএসআই(নিঃ)/ হিরু’র প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় বন্ড সই দিয়ে উক্ত হাসপাতালে ভর্তি করা হয় প্রতীককে। অনেক চেষ্টার পর ফোনে পাওয়া যায় প্রতীকের মা’কে। প্রতীকের বাবার মাধ্যমে খবর পেয়ে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হাসপাতালে আসেন ইন্সপেক্টর আসাদুজ্জামান সাহেব। তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করলে প্রতীকের বাবা মা পরদিন চলে আসেন চট্টগ্রামে। ততক্ষণে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যায় অনেকটা সুস্থ হয়ে যায় প্রতীক। পুলিশ সদস্য মমিনের মহানুভবতার কারণে প্রতীক ফিরে পায় তার পরিবারকে। মমিনের সাথে দেখা না হলে হয়তো প্রতীকের জীবনে ঘটে যেত বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এমনকি জীবনাবসান হলে হ্য়তো অজ্ঞাত লাশ হিসেবে সুরতহাল রিপোর্ট করতে হতো পুলিশকে। ময়না তদন্ত শেষে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে সৎকার হত কোন অজ্ঞাত কবরস্থানে। বাবা-মা জানতেও পারতেন না তাদের আদরের ক্যাডেট সন্তান বেঁচে আছে কিনা। সারা জীবন অপেক্ষায় থাকতেন কবে ফিরে আসবে প্রতীক। কিন্তু অপেক্ষায় প্রহর শেষ হত না কখনও।
পরবর্তীতে জানা যায়, দোহার নবাবগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আব্দুর রশিদ প্রতীকের বাবা। মা এলিনা পারভীন, জিবিজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঘাটাইল, টাংগাইল এর বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাশ করে বড় ছেলে মিনার মাহমুদ প্রতীক। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পদে চাকুরির জন্য আবেদন করেন তিনি। কিন্তু চাকুরি না হওয়ায় সে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শিক্ষক বাবা-মা চেষ্টা করেন সাইক্রিয়েটিক চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করানোর।
গত ০১ মার্চ, ২০১৯ইং বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে যায় প্রতীক। অনেক খুঁজে না পেয়ে ঘাটাইল থানায় একটি হারানো জিডি করেন তারা। তিন মাস ছেলের কোন খবর না পেয়ে দিশেহারা হয়ে যান বাবা-মা। অপেক্ষায় থাকেন কখন ফিরে আসবে প্রতীক, কিন্তু আসে না। তবে গত ১৫ জুন সন্ধ্যায় হঠাৎ একটি ফোন আসে। অবাক হয়ে যান প্রতীকের মা। প্রতীককে মুমূর্ষু অবস্থায় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন এক ব্যক্তি। অনেক টাকার প্রয়োজন প্রতীককে চিকিৎসা করাতে, যার সম্পূর্ণটাই বহন করছিলেন তিনি। দ্রুত হাসপাতালে এনে চিকিৎসা না করালে ঘটে যেতে পারতো কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যিনি ফোন দিয়েছিলেন, তিনি একজন পুলিশ সদস্য। বিষয়টি প্রথমে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি প্রতীকের মা। বিষয়টির সত্যতা জানতে প্রতীকের বাবা তার প্রাক্তন ছাত্র পুলিশ ইন্সপেক্টর জনাব আসাদুজ্জামান ’কে জানান। আসাদ সাহেব কক্সবাজার জেলার ঈদগাহ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত। সৌভাগ্যবশতঃ তিনি যখন ফোন পেয়েছেন তখন তিনি সরকারী কাজে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। যে পুলিশ সদস্য ফোন দিয়েছিলেন, তার মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে কথা বলেন আসাদ সাহেব। পরিচয় জানার পর নিশ্চিত হয়ে তিনি ছুটে যান হাসপাতালে এবং তিনি নিশ্চিত করলে ছুটে আসেন প্রতীকের বাবা-মাও। বেঁচে যায় প্রতীকের প্রাণ।
এমন মানবিক ও মহানুভব কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই পুলিশ পরিবারের গর্বিত সদস্য মমিনকে। মমিন এর মত পুলিশ আছে বলেই আজও প্রতীকের বাবা মায়েরা খুঁজে পায় তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে এবং প্রতীকের বাবা মায়ের মত হাজারও মুখে উচ্চারিত হয় “ধন্যবাদ পুলিশ”।
সুত্র: সিএমপি ফেসবুক পেইজ