নিরেন দাস(জয়পুুরহাট)প্রতিনিধিঃ-
জয়পুরহাট সদরের দোগাছি গ্রামের হতদরিদ্র আতিকুল ইসলাম ও স্ত্রী নাজমা বেগম। অভাবের তাড়নায় আতিকুল কখনো ভ্যানচালক, আবার কখনো দিনমজুর ও স্ত্রী নাজমা কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ অথবা নিজ বাড়ির হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করতেন। সেই পরিশ্রমের টাকা, প্রতিবেশী ও বিত্তবানদের সহযোগিতায় নিজের মেধাবী বড় ছেলে আকাশকে (২১) ভর্তি করিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)।
মা-বাবার আশা ছিল আর দুই বছর পরই ছেলে আকাশ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরে আনবে এবং নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট বোন মরিয়ম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাই ইয়ামিনকে তার মতো উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবে।
কিন্তু গত মঙ্গলবার টেলিভিশনে দেখে প্রতিবেশীরা তাদেরকে জানায় বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আকাশ গ্রেপ্তার হয়েছে। তখনই তিলে তিলে গড়া সেই স্বপ্নগুলো মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার পথে।
কান্না জড়িত কণ্ঠে আকাশের মা নাজমা বেগম বলেন, স্থানীয় দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এস.এস.সি’তে গোল্ডেন জিপিএ ৫, ২০১৬ সালে জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে এমন স্বপ্নে তাকে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি করা হয়।
আকাশের মা আরও বলেন, তাকে পড়াতে গিয়ে অভাবের তাড়নায় স্থানীয় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৪০হাজার ও গরু পালনের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। আর দুই বছর পরই আকাশ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সংসারের সচ্ছলতা পথ দেখাবে ঠিক তখনই সব অন্ধকার হয়ে গেল।
তার অসুস্থ বাবা আতিকুল বলেন, আমাদের জানা মতে আকাশ কোন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কিন্তু কেন এত বড় ঘটনায় সে জড়িয়ে গেল এখন আমার ছোট দুই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার কি হবে? আল্লাহর কাছে বিচার দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
আকাশের ছোট বোন মরিয়ম বলেন, ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ার হবে, আমি ডাক্তার হব। এখন যেন সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে ছোট ভাই ইয়ামিন বলেন, আকাশ ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ার হবে, আমি সেনাবাহিনীর অফিসার হব। কিন্তু তা বুঝি আর হলো না।
আকাশের নানা আব্দুল হামিদ, ফুফু মাসুমা আক্তার, চাচা আব্দুল মাবুদ বলেন, মেধাবী হওয়ায় তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতাম। তার পরিবার দরিদ্র, বসতবাড়ির ১৬ শতক জমি ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। এ কারণেই আমরা সবাই সহযোগিতা করতাম। আকাশ আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে তা আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না। সে কখনোই এমন কাজ করতে পারে না। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী আশরাফ আলী, মাহফুজুল ইসলামসহ অনেকেই বলেন একই কথা।
তার সহপাঠী বন্ধু মেহেদী হাসান, সিফাত হাসান, আশরাফুল ইসলামসহ অনেকে বলেন, আকাশ ছুটি পেলেই গ্রামে এসে আশপাশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সম্পর্কে ধারণা ও তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করত। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। তারা অনেক দরিদ্র হওয়ায় আমরাও তাকে সহযোগিতা করতাম। গত ঈদে ছুটিতে এসে ঢাকা যাওয়ার সময় তার কাছে টাকা না থাকায় আমরা তাকে টাকা দিয়েছিলাম। সে কীভাবে এমন ঘটনায় জড়িয়ে গেল, তা আমরা ভাবতে পারছি না।
আকাশের স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন সাংবাদিককে বলেন, ক্লাস ওয়ান থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমি তাকে চিনি এবং পড়িয়েছি। কোন সময় সে শৃঙ্খলা বহির্ভূত কাজ করেনি। সে অত্যন্ত নরম স্বভাবের ছেলে, মাথা উঁচু করে কথা বলত না। পরিবার দরিদ্র হওয়ায় স্কুল ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতার পাশাপাশি আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাহায্য করেছি। তার জড়িত থাকার বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করা দরকার।
দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম জানান, এলাকায় সে অত্যন্ত ভালো ও মেধাবী ছেলে ছিল। আবরার হত্যায় তার জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি শুনে আমি হতবাক। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে নিরপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি।
উল্লেখ্য, গত রবিবার (৬ অক্টোবর) রাতে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নিজ কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যায় তার বাবা ১৯জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ওই ১৯জনকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করেছে। তাদের মধ্যে জয়পুরহাটের ভ্যানচালক আতিকুল ইসলামের ছেলে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র আকাশ হোসেন ১৩নং আসামি। গত বুধবার আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।