কামাল হোসেন:-
রাস্তার ধারে পড়ে থাকা একজন অজ্ঞাত, অচেনা,অসুস্থ বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস পাওয়া যায়,যেটা চোখে পড়ে স্বপ্নযাত্রীর প্রবাসী সদস্য হেলাল আহমেদের। তিনি তৎক্ষনাৎ পোস্টটি স্বপ্নযাত্রী পরিবারের গ্রুপে শেয়ার করেন।
চান্দগাঁও মোহরাস্থ কাজীর হাট জালালাবাদ স্টেশনে ঠিকানা বিহীন একজন অজ্ঞাত, অপরিচিত, অজানা মানুষ অনেকদিন ধরে পড়ে আছেন। যিনি চলাচলে অক্ষম,অসুস্থ,কাপড়চোপড় খুবই খারাপ,এমনকি দুর্গন্ধের কারণে কেও কাছেও যেতে পারছেনা।
এরকম একজন মানুষের দায়ভার কেই বা নিতে চাই?
গত ৪ই নভেম্বর সেই ধারণাকে অতীতের মত বুড়ো আংগুল দেখিয়ে অনতিবিলম্বে কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে ছুটে যায় স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশন মহানগর শাখার ফুডব্যাংক লিডার জাদুরাজ নাইম। তখন ওনার শারিরীক অবস্থার খুবই অবনতি ছিল।
হবেইনা বা কেন ধারণা করা হচ্ছে অজ্ঞাত বৃদ্ধ বাবাটি প্রায় ২০দিন আগে থেকেই এখানে অভুক্ত এবং মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছিল।নাইম উনার নাজুক অবস্থা দেখে স্বপ্নযাত্রী পরিবারে জানালেন উনার চিকিৎসা প্রয়োজন,দ্রুত হসপিটালে এডমিট করতে হবে।
স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কামাল হোসেন একটি টিম পাঠালেন সেই অজ্ঞাত মুমূর্ষু বৃদ্ধটিকে হসপিটালে আনার জন্য।
সেই টিমে ছিলেন স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশন মহানগর শাখার যুগ্ন-সম্পাদক আবিদ হোসেন,প্রচার সম্পাদক জহিরুল ইসলাম,দপ্তর সম্পাদক শিহাব।
তারা সবাই মিলে বৃদ্ধ বাবাটিকে গোসল করালেন,ভাল কাপড়চোপড় পড়ালেন এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসলেন, মেডিকেলে এডমিট করালেন,চিকিৎসা শুরু হল (৩য় তলায় ১৬নং ওয়ার্ড)। কিছু খাওয়া দাওয়া করিয়ে উনাকে পরম যত্নে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। জানা নেই কতটি রাত কতটি দিন তিনি চরম কষ্টে অনাহারে, অযত্নে স্টেশনের ধারে পড়েছিলেন। তবে উনি তখনো কথা বলতে পারছিলেন না তাই উনার পরিচয় জানতে পারা সম্ভব হয়নি।
মেডিকেলে আনতে ফ্রি এম্বুল্যান্স সার্ভিস দিয়ে উপকৃত করেছিলেন আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশন। মেডিকেলে উনার ওষুধপত্র,টেস্ট করা, খাওয়া দাওয়া, কাপড়ের জন্য আর্থিক সাপোর্ট ও দরকার,আবার মেডিকেলে উনার সাথে কাওকে থাকার ও দরকার। জাদুরাজ নাইম রাতে বৃদ্ধ বাবাটির সাথে রাতে মেডিকেলে থাকলেন উনার সুবিধা-অসুবিধায় রাত জেগেছেন।
৫ই নভেম্বর স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশনের নারী সদস্যা জান্নাতুল ফেরদৌসে আনিকা গেলেন বাবাটির যত্ন নিতে পরিচর্যা করতে। নিজের বাবার মত করেই আনিকা বৃদ্ধ বাবাটিকে খাবার খাওয়ালেন পাশে ছিলেন সারাদিন। আর জাদুরাজ তো উনার টয়লেট ও পরিষ্কার করে দিচ্ছেন নিয়মিত নিজহাতে।
আল্লাহর রহমতে একটু অবস্থার উন্নতি দেখা গেল,উনার প্রাথমিক চিকিৎসার খরচ চালাতে স্বপ্নযাত্রীর সদস্যরা সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্য করছেন এবং বেশকিছু শুভাকাঙ্ক্ষীও এগিয়ে এলেন।
অন্যরাতের মতো সেই রাতেও জাদুরাজ নাইম মেডিকেলে বাবাটির সাথে থাকছেন এবং উনার সেবা করেছেন।
৬ই নভেম্বর বৃদ্ধ বাবাটির শারিরীক অবস্থার উন্নতি ঘটছে এবং হালকা কথা বলতে পারছেন।তবে শুধুমাত্র উনি উনার নাম জানালেন। উনার নাম আবু সিদ্দিক। উনার ঠিকানা জানতে চাইলে উনি অনেক কান্না করলেন।
কিন্তু স্বপ্নযাত্রীর স্বপ্নবাজরা উনার সেবা করার কোন ত্রুটি রাখছেন না।একেকজন একেকসময়ে এসে উনার খবরাখবর রাখছেন সেবা করছেন,পাশে থাকছেন। এক্ষেত্রে ডাক্তার,নার্সরাও খুবই মানবিকতা দেখিয়েছেন, উনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন স্বপ্নযাত্রী সদস্যরা।
৭ই নভেম্বর, বৃদ্ধ, অক্ষম,অসুস্থ বাবাটি মোটামুটি সুস্থ হলেন, এমনকি হালকা হাটাহাটি করলেন, হালকা কথা বলতে চেষ্টা করলেন। সেদিন উনার পাশে থাকতে, সেবা করতে এসেছিলেন স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশনের অন্যতম নারী সদস্যা সানজিদা আফরোজ,মোহাম্মদ মনজু,মেজবাজ উদ্দীন। এভাবেই প্রতিটি স্বপ্নবাজরা বাবাটিকে সুস্থ করে তুলতে পরিশ্রম করছেন। উনাকে আরো কিছু টেস্ট করালেন। আর্থিক সাহায্য করে অনেকেই পাশে ছিলেন।
কিন্তু উনার ঠিকানা তখনো জানা সম্ভব হচ্ছিল না।তবে প্রতিনিয়ত উনার শারিরীক অবস্থার আপডেট এবং পরিচয় জানতে, ঠিকানা জানতে অনলাইনে প্রতিটি সদস্যরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। উনার পরিবারকে যাতে খবরটি পৌছানো যায় সেজন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন সবাই।
৮ই নভেম্বর, প্রতিনিয়ত বৃদ্ধ বাবাটির সেবার জন্য লেগেই আছেন জাদুরাজ নাইম। তার সাথে সঙ্গ দিতে পালাবদল করে অনেকেই থাকছেন।যাতে উনার সেবার কোন কমতি না হয়। যে যার যার কর্মব্যস্ততা উপেক্ষা করে বৃদ্ধ বাবাটির সেবা করতে যতটুকু পারছেন সময় দিচ্ছেন। সেদিন গিয়েছিলেন স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশন আনোয়ারা শাখার সভাপতি কাজী আবু ফয়েজ সহ আরফি ইসলাম,জনি সহ অনেকেই।
সময় তখন প্রায়ই সন্ধ্যা,হঠাৎ করেই কল আসেন যিনি ফোনের ওপাশ থেকে পরিচয় দেন বৃদ্ধ আবু বক্কর সিদ্দিকের আত্নীয়। উনি বৃদ্ধটির খবর পেয়েছিলেন মোহাম্মদ মনজুর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে।
বৃদ্ধা বাবাটির ঠিকানা,সাতকানিয়া বাজালিয়া পূর্ব মাহালিয়ায়।উনি ছিলেন একজন গ্রাম্য কবিরাজ।
অক্টোবর মাসের ২তারিখ তিনি কাওকে না জানিয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন।
আল্লাহর অশেষ রহমতে স্বপ্নযাত্রীর স্বপ্নবাজদের কঠোর পরিশ্রমে বৃদ্ধ বাবাটি অনেকটা সুস্থ এবং আপন পরিবারের খোজ পেয়েছেন।
উনার স্ত্রী এবং মেয়ের জামাই এসেছেন মেডিকেলে,স্বপ্নযাত্রীর সদস্যদের সাথে তাদের কথাবার্তা হয়েছে এবং বিস্তারিত সবকিছু জেনেছেন এবং উনার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করবেন।
এটাই স্বার্থকতা,এটাই মানবতা।এইভাবে পিড়ীতের সেবা করাই মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার পরিচয়।স্বপ্নবাজরা সেটি করে দেখিয়েছে।
স্যালুট স্বপ্নবাজদের। যারা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন,যারা পাশে থেকেছেন,পরম যত্নে সেবা করেছেন,আপন সন্তান-সন্তনীর মত যত্ন করেছেন, আর্থিক সাহায্য করেছেন,ঠিকানা খুজে পেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন,সবসময় খবরাখবর রেখেছেন সবাইকে।
সবশেষে বৃদ্ধ বাবাটিকে স্বজনদের কাছে তুলে দিলেন স্বপ্নযাত্রীর সদস্যরা।